ভূমি জরিপের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ: প্রাচীন কাল থেকে ডিজিটাল যুগ
সিএস, এসএ, আরএস থেকে শুরু করে ডিজিটাল জরিপ পর্যন্ত সবকিছুর বিস্তারিত তথ্য
ভূমি জরিপ কী?
ভূমি জরিপ বা Land Survey হলো এমন একটি বিজ্ঞানসম্মত কৌশল, যার মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে ভূপৃষ্ঠের কোনো স্থানের ভৌগোলিক অবস্থান, দূরত্ব এবং কোণ নির্ণয় করা হয়। সহজ কথায়, মৌজা ভিত্তিক ভূমির নকশা (ম্যাপ) তৈরি এবং ভূমির মালিকানা সম্পর্কিত খতিয়ান বা রেকর্ড প্রস্তুত করার কার্যক্রমকেই ভূমি জরিপ বলা হয়।
ব্রিটিশ আমল ও প্রাথমিক জরিপসমূহ
আদি ইতিহাস
প্রাচীন মিসরে নীল নদের বন্যার পর সীমানা নির্ধারণে দড়ির ব্যবহার হতো। উপমহাদেশে শেরশাহ প্রথম জরিপ চালু করেন এবং সম্রাট আকবরের সময় টোডরমল সার্ভে কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
রনাল ও ত্রিগনোমেট্রিক্যাল জরিপ
১৭৮০ সালে জেমস রনাল বাংলার মানচিত্র তৈরি করেন। ১৮০২ সালে উইলিয়াম ল্যাম্বটনের নেতৃত্বে জি.টি. পিলার স্থাপনের মাধ্যমে ত্রিগনোমেট্রিক্যাল জরিপ শুরু হয়।
থাকবাস্ত ও খসড়া জরিপ
১৮৪৬ সাল পর্যন্ত জমিদারী সীমানা নির্ধারণে থাকবাস্ত জরিপ হয় (নকশাবিহীন)। পরবর্তীতে চরাঞ্চল বা নকশাবিহীন এলাকায় খসড়া জরিপ পরিচালিত হতো।
রাজস্ব জরিপ
১৮৪৭-১৮৭৮ সাল পর্যন্ত জমিদারী আয় নির্ণয় ও খাস জমি চিহ্নিত করতে এই জরিপ হয়। একে প্রথম বৈজ্ঞানিক জরিপ বলা হয়।
বাংলাদেশে প্রচলিত প্রধান জরিপসমূহ
১. সি.এস. জরিপ (Cadastral Survey)
সবচেয়ে নির্ভুল“সিএস” হলো Cadastral Survey (CS) এর সংক্ষিপ্ত রূপ। একে ভারত উপমহাদেশের প্রথম জরিপ বলা হয় যা ১৮৮৮ (ভূমি মন্ত্রণালয় অনুসারে ১৮৮৭) সাল হতে ১৯৪০ সালের মধ্যে পরিচালিত হয়। এই জরিপ ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের ১০ম পরিচ্ছেদে অনুসারে সিলেট ও পার্বত্য জেলা ব্যতীত সারা দেশে পরিচালিত হয়। উক্ত জরিপের মাধ্যমে জমির বিস্তারিত মৌজা নকশা (ম্যাপ) প্রস্তুত করা হয় এবং প্রত্যেক মালিকের জন্য দাগ নম্বর উল্লেখপূর্বক ভূমির বাস্তব অবস্থা, আয়তন, শ্রেণী, পরিমাণ, খাজনার পরিমাণ ইত্যাদি উল্লেখপূর্বক খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়। এ জরিপ পি-৭০ সীটে কিস্তোয়ারের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। সিএস জরিপ ১৮৮৮ সালে কক্সবাজারের রামু থানা হতে আরম্ভ হয় এবং ১৯৪০ সালে দিনাজপুর জেলায় শেষ হয়। সে সময়ে সিলেট জেলা আসাম প্রদেশের অধীন থাকায় সিলেট জেলায় সিএস জরিপ হয়নি। তবে জরুরী বিবেচনায় ১৯৩৬ সালের সিলেট প্রজাস্বত্ব আইনের (Sylhet tenancy Act) আওতায় সিলেট জেলার ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে ১৯৫০ সালে আরম্ভ করা হয় এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর অধীনে ঐ জরিপ ১৯৬৩ সালে শেষ হয়। সি.এস. জরিপে সময় প্রস্তুতকৃত খতিয়ানে জমিদারগণের নাম খতিয়ানের উপরিভাগে এবং দখলকার রায়তের নাম খতিয়ানের নিচে লেখা হত। সে সময় জমিদারগণ সরকার পক্ষে জমির মালিক ছিলেন এবং রায়তগণ প্রজা হিসেবে শুধুমাত্র ভোগ দখলকার ছিলেন। প্রথম জরিপ এই জরিপ এবং প্রস্তুতকৃত নকশা ও খতিয়ান খুবই নিখুঁত ও নির্ভরযোগ্য হিসেবে এখনো গ্রহণীয়। মামলার বা ভূমির জটিলতা নিরসনের ক্ষেত্রে এই জরিপকে বেস হিসেবে অনেক সময় গণ্য করা হয়।
২. এস.এ. জরিপ (State Acquisition Survey)
পি.এস. জরিপ১৯৫০ সালে জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হওয়ার পর সরকার ১৯৫৬ সালে সমগ্র পূর্ববঙ্গ প্রদেশে জমিদারি অধিগ্রহনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ২/৪/১৯৫৬ তারিখে এই আইনের ৩ ধারার আওতাধীন বিজ্ঞপ্তির মূলে সরকার কর্তৃক সকল জমিদারি দখল নেয়ার পর উক্ত অ্যাক্টের ১৭ ধারা মোতাবেক যে খতিয়ান প্রস্তুত করা হয় তা এস এ খতিয়ান বলে পরিচিত। মূলত, জমিদারী ও মধ্যস্বত্ব বিলোপ করে জমিদারগণকে প্রদেয় ক্ষতিপূরণ তালিকা প্রণয়ন এবং ভূমি মালিকগণকে/রায়তকে সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আনয়ন করার লক্ষ্যে সে সময় একটি সংক্ষিপ্ত জরিপ ও রেকর্ড সংশোধনী কার্যক্রম পরিচালিত হয় যা পরবর্তীতে এসএ খতিয়ান বলে পরিচিত পায়। ১৯৫৬ হতে ১৯৬২ পর্যন্ত এই জরিপ পরিচালিত হয়। জরিপে ভূমি মালিকের নাম ও জমির বিবরণাদি সম্বলিত হাতেলেখা রেকর্ড/খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়। সে সময় এই রেকর্ড মোট তিন কপি প্রস্তুত করা হয় যার মধ্যে একটি জেলা রেকর্ড রুমে, এক কপি তহশলি ( ইউনিয়ন ভূমি অফিস) অফিসে এবং অন্যটি সার্কেল পরিদর্শক (উপজেলা রাজস্ব) অফিসে প্রদান করা হয় । জরুরী তাগিদে জমিদারগণ হইতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই জরিপ বা খাতিয়ান প্রণয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল। একে পাকিস্তান সার্ভে (PS) ও বলা হয়।
৩. আর.এস. জরিপ (Revisional Survey)
হালনাগাদ জরিপসি.এস. জরিপ সম্পন্ন হওয়ার সুদীর্ঘ ৫০ বছর পর এই জরিপ পরিচালিত হয়। জমির অবস্থা, প্রকৃতি, মালিক, দখলদার ইত্যাদি হালনাগাদ করার লক্ষ্যে এ জরিপ সম্পন্ন করা হয়। এস.এ. জরিপের সময় সরেজমিনে তদন্ত বা জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা হয়নি। জমিদারদের থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এস.এ জরিপ বা খাতিয়ান প্রস্তুত করা হয়েছিল যার কারণে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে যায়। এই ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করার জন্য সরকার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরেজমিনে ভূমি জরিপ করার সিদ্ধান্ত নেয় যা আর.এস বা. Revisional Survey জরিপ হিসেবে পরিচিত। এই জরিপে প্রস্তুতকৃত নকশা (ম্যাপ) এবং খতিয়ান নির্ভুল হিসেবে গ্রহণীয়।।
দিয়ারা জরিপ (Diara Survey)
নদী ভাঙন বা পলি জমে নতুন চর জেগে উঠলে ভৌগোলিক পরিবর্তন হয়। তখন জেলা প্রশাসকের চাহিদার ভিত্তিতে ১৮৬২ সাল থেকে এই জরিপ ব্যবস্থা চালু আছে। দরিয়া বা নদী থেকেই 'দিয়ারা' শব্দের উৎপত্তি।
সিটি জরিপ (City Survey)
একে 'ঢাকা মহানগর জরিপ'ও বলা হয়। ১৯৯৯-২০০০ সালের মধ্যে এই আধুনিক জরিপ সম্পন্ন হয়। এই জরিপের খতিয়ান বা পরচা হাতে লেখা নয়, বরং কম্পিউটার প্রিন্টেড হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভে (BDS)
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে ২০১৩ সাল থেকে আধুনিক যন্ত্রপাতি যেমন GNSS, ETS এবং ড্রোন ব্যবহার করে এই জরিপ চলছে। এর মাধ্যমে জমির দাগ ও সীমানা নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে, যা ভূমি বিরোধ কমাতে সহায়ক।

Comments